
দিনটা ছিল ২১ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২০। কাল থেকে জারিনার স্বামী ঘরে ফেরেনি। ওষুধ কিনতে বেরিয়েছিল মাজেদ আলি। ঘরে ফিরছেনা কেন,এত দেরী হওয়ার তো কথা নয়! কাছের মানুষের নম্বর ডায়েল করতেই অপর প্রান্ত থেকে বলে উঠলো ‘আপনি যে নম্বরটিতে যোগাযোগ করতে চায়ছেন সেটি এখন সুইচড অফ আছে- অনুগ্রহ করে কিছুক্ষণ বাদে আবার চেষ্টা করুন’। বার বার কল করলেও সেই একই কথা। বাধ্য হয়ে পরের দিন জারিনা পার্ক স্ট্রিট পুলিশ স্টেশনে দৌড়ে যায় মিসিং ডায়রি লিখতে।
একদিন হঠাত’’ মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে জারিনার। বঙ্গবন্ধুর খুনি হিসেবে মাজিদের গ্রেফতারির খবরের সাথে যে ছবি ছাপা হয়েছে, সে তো তার স্বামী, যার সাথে প্রায় ১০ বছর ধরে বিবাহিত জীবন কাটাচ্ছে। এই মানুষটারই ফাঁসি হবে! সমস্ত ঘটনা জানার পরে কার্যত বাকরুদ্ধ হয়ে যায় জারিনা। বারবার শুধুই অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছে সে।
জারিনা পরে সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, তাঁর বাড়ি উলুবেড়িয়া গ্রামে। জারিনার যখন ৩১ বছর বয়স তখন বছর ৬৪-র আলি আহমেদের সাথে বিয়ে হয়। যদিও কয়েক বছর আগে তাঁর প্রথম বিয়ে হয়েছিল,কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যেই স্বামী মারা যাওয়ায় ছোট সন্তানকে নিয়ে ফিরে আসেন বাপের বাড়িতে। প্রতিবেশীর সূত্রে সম্বন্ধ আসে আলি আহমেদের। ধার্মিক শিক্ষক আলি আহমেদের রোজগার মন্দ নয় তাই বাড়ির লোকজন আর দেরি করেনি। জরিনাকে তড়িঘড়ি বিয়ে দিয়ে দেয় ৬৪ বছরের আলি আহমেদের সাথে।
জরিনা বলেন, “ও বরাবর খুবই স্বল্প ভাষী। কয়েক বার ওর গ্রামের কথা, পরিবারের কথা জানতে চেয়েছিলাম কিন্তু ও খুব রেগে যেত। তাই আমি আর বেশি কিছু কখনও বলিনি। আমি বিয়ের পর থেকেই দেখছি, নিয়ম করে দিনে পাঁচ বার নমাজ পড়ত- ধার্মিক মানুষ হিসেবেই চিনি ওকে”।
১৯৭৫ সালের ১৫ ই আগস্ট শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার পরিবারের বেশির ভাগ সদস্যকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। বলা বাহুল্য আব্দুল মাজেদ ওরফে আহমেদ আলী সরাসরি এই হত্যাকাণ্ডের সাথে যুক্ত ছিলেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার দীর্ঘ ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে এই মামলার বিচার শুরু হয়। বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচার শুরু হলে মাজেদ বিপদ বুঝে আত্মগোপন করেন। নিজের পরিচয় বদলে এপার বাংলায় প্রায় ২২ বছর ধরে লুকিয়ে থাকলেও শেষ রক্ষা হলো না তার। দীর্ঘদিন ধরে পশ্চিমবঙ্গের কলকাতাসহ নানা জায়গায় লুকিয়ে শেষে কলকাতার বেডফোর্ড স্ট্রিটে জারিনার সঙ্গে ঘর বেঁধেছিল সে। সেই এলাকায় ইংরেজির মাস্টারমশাই বলেই পরিচিত। সব দিক থেকেই নিজের পরিচয় গোপন করে অন্য মানুষ হিসেবে জীবন যাপন করছিল। ২১শে ফেব্রুয়ারি বাড়ি থেকে নিখোঁজ হওয়ার পরে জারিনার নিখোঁজের ডায়েরি পেয়ে তদন্ত শুরু করে পুলিশ। সিসিটিভিতে ধরা পড়ে মাজেদ সহ সন্দেহভাজন ৪ জন ব্যক্তি একটি বাসে উঠেছে। কিন্তু তারপরে তার গতিবিধির আর কোন ফুটেজ পাওয়া যায়নি। এরপর ৭ ই এপ্রিল মাজেদকে গ্রেপ্তার করা হয় বাংলাদেশের মিরপুর এলাকা থেকে। ঢাকার গোয়েন্দারা জানিয়েছেন, ঢাকায় চার মেয়ে ও এক ছেলে নিয়ে মাজেদের পরিবার রয়েছে । তাঁদের মধ্যে দুই মেয়ে ও এক ছেলে বিদেশে থাকেন। মাজেদের স্ত্রী সালেহা বেগম এবং দুই মেয়ে ফাতেমা সিদ্দিকা ও মাসুমা সিদ্দিকা ঢাকায় থাকেন। তিন জনই পেশায় চিকিৎসক। এই ফাতেমার সঙ্গে মাজেদের নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। মাজেদের ভাই শাহজাহান চৌধুরী থাকেন চট্টগ্রামে, তাঁর সঙ্গেও যোগাযোগ ছিল মাজেদের। ১২ই এপ্রিল রাত ১২ টায় কেরানীগঞ্জের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে মাজেদের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। এর পর থেকে আর মাজেদের পরিবারের কারও সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি। এ ব্যাপারে অবশ্য জারিনা কিছুই জানতেন না। সবকিছু জানার পর তিনি বিশ্বাসই করে উঠতে পারছেন না- যে মানুষটার সাথে এত বছর ধরে সংসার করলেন তিনিই কিনা একজন সাবেক বাংলাদেশী সামরিক অফিসার আবার বাংলাদেশের স্থপতি, প্রথম রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের জন্য আত্মস্বীকৃত ও মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামী।
