
করোনা আবহে মিলল অতি প্রাচীন স্থাপত্যের হদিশ। দীর্ঘ দিন লকডাউনের কারণে দূষণের মাত্রা কমে যাওয়ায় হ্রদের জল এখন খুব স্বচ্ছ। এর আগে এতটা জলের স্বচ্ছতা ছিল না, যদি থাকত তাহলে মানুষ অনেক আগেই তুরস্ক দেশের ইজনিক হ্রদের নিচে থাকা অতি প্রাচীন স্থাপত্যের নমুনার সাক্ষী থাকত। প্রায় ১৬০০ বছর পর মনুষ্য চক্ষে এই স্থাপত্য দেখে কার্যতই অবাক হয়ে গিয়েছেন। ইজনিক হ্রদের পৃষ্ঠদেশ থেকে তোলা ছবি রীতিমতো ভাইরাল হয়ে উঠেছে সামাজিক মাধ্যমের ভার্চুয়াল গ্যালারি। এই প্রাচীন গির্জাটির অস্তিত্ব অবশ্য আবিষ্কার হয়েছে আগেই, ২০১৪ সালে একদল মার্কিন প্রত্নতাত্ত্বিক জলের নিচে এই স্থাপত্যের নমুনা খুঁজে পান। পরবর্তী গবেষণায় জানা যায়, আনুমানিক ৩৯০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ তৈরি হয়েছিল এই রোমান স্থাপত্যটি। যখন ইস্তাম্বুল পরিচিত ছিল কনস্ট্যান্টিনোপল নামে। আর এই গির্জার নাম ছিল ব্যাসিলিকা। অবশেষে ৭৪০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ নেমে আসে বিপর্যয়। ভূমিকম্পের কবলে পড়ে এই স্থাপত্যটি, শেষ পর্যন্ত হ্রদের গভীরে তলিয়ে যায় ব্যাসিলিকা।
প্রকৃতির নিয়মে হ্রদের জলের নিচে প্রাচীন গির্জার ধ্বংসস্তূপের উপর জন্মেছে সবুজ শ্যাওলার আস্তরণ, ক্ষয় পেয়ে ম্লান হয়ে গেছে শিল্পীদের পরিশ্রমসাধ্য নকশার লালিত্য- বর্তমান ছবিতেও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে জরাজীর্ণতার ছাপ। প্রকৃতির নিয়মেই যে স্থাপত্য একদিন সবার অলক্ষ্যে ইজনিক হ্রদে তলিয়ে গিয়েছিল কালের নিয়মে সে নিজেই ইতিহাসের পাতা উল্টে; মানবজাতিকে হতবাক করে; তুরস্কের বুকে আবির্ভূত হয়েছে। সে দেশে ইজনিক হ্রদের নীচে দেখা যাচ্ছে ৩৯০ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত গির্জার ভগ্নাবশেষ। পুরাবিদ ও ইতিহাসবিদদের ধারণা, ৭৪০ খ্রিস্টাব্দে ভূমিকম্পের ফলে স্থাপত্যটি ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তার পর ধীরে ধীরে তাকে গ্রাস করে ইজনিক হ্রদের জল। তলিয়ে যাওয়া ঐতিহাসিক নিদর্শনটি রয়েছে জলতল থেকে মাত্র দেড় থেকে দু’মিটার গভীরে।
১৬০০ বছরের প্রাচীন গির্জার ধ্বংসাবশেষ
আর্কিয়োলজিক্যাল ইনস্টিটিউট অফ আমেরিকা সে সময় এটিকে বছরের সেরা দশটি ঐতিহাসিক আবিষ্কারের মধ্যে জায়গা দিয়েছিল। তবে এই প্রথম এত স্পষ্ট করে এটিকে দেখা গেল জলের উপর থেকেই। স্থানীয় প্রশাসনের তরফে ড্রোনের মাধ্যমে ছবিও তোলা হয়েছে। বর্তমান ছবি দেখে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন উলুদাগ ইউনিভার্সিটির প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের প্রধান মুস্তাফা শাহীন। ৫ বছর ধরে ইজনিক হ্রদের গভীরে নমুনা সংগ্রহের কাজ করে আসছেন তিনি এবং তাঁর সহকর্মীরা। লকডাউনের ফলে সেই পরিচিত জায়গার এমন অসাধারণ ছবি দেখে তাই বিস্মিত। সেইসঙ্গে এই ঐতিহাসিক স্থাপত্যের ধ্বংসস্তূপ সাধারণ মানুষের কাছে আগ্রহের বিষয় হয়ে উঠতে পারে বলে তিনি যথেষ্ট আশাবাদী।
গবেষকদের মতে, ১৬০০ বছর আগে সন্ত নিওফাইটোসের সম্মানে এই গির্জা তৈরি করা হয়েছিল। সে সময় ইজনিকের নাম ছিল নাইসিয়া। রোমান সম্রাট কনস্টানটাইনের নাম অনুসারে ইস্তানবুল ছিল কনস্টাটিনোপল। রোমান সম্রাট ডায়োক্লেশিয়ান এবং গ্যালেরিয়াসের আমলে সন্ত নিওফাইটোসকে প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়েছিল। যে স্থানে সন্তকে প্রাণদণ্ড দেওয়া হয়েছিল, তাঁর সম্মানে সেখানেই পরে গির্জাটি নির্মাণ করা হয়। মধ্যযুগের বিভিন্ন নথিতে দাবি করা হয়েছে, ইজনিক হ্রদের তটের বধ্যভূমিতে প্রাণদণ্ড দেওয়া হয় সন্ত নিওফাইটোসকে। অনেক গবেষকদের মতে, ইজনিক হ্রদের নীচে একটি মন্দিরের ধ্বংসাবশেষের উপরে ওই গির্জা তৈরি করা হয়। ইতিহাসবিদেরা নিশ্চিত, গির্জার ধ্বংসস্তূপের নীচে আরও প্রাচীন সভ্যতার চিহ্ন আছে। এমনটা দাবি করার পিছনে কারণ হল, হ্রদ থেকে রোমান সম্রাট অ্যান্তোনিয়াস পায়াসের সমকালীন মুদ্রা ও অন্যান্য প্রত্নতাত্ত্বিক জিনিসের সন্ধান মিলেছে। পরবর্তী সময়ের বিভিন্ন শাসক যেমন সম্রাট ভ্যালেন্স, সম্রাট দ্বিতীয় ভ্যালেন্তাইনিয়ানের সমসাময়িক মুদ্রার নিদর্শনও পাওয়া গিয়েছে। রোমান সম্রাট অ্যান্তোনিয়াস পায়াস ১৩৮ থেকে ১৬১ খ্রিস্টাব্দ অবধি সিংহাসনে আসীন ছিলেন। তাঁর আমলে বা আরও আগে ওই স্থানে প্রাচীন গ্রিক সভ্যতার দেবতা অ্যাপোলোর মন্দির ছিল বলে অনুমান করা হয়। তাই হ্রদের তলদেশ খনন করলে সেই সভ্যতার সন্ধান পাওয়া যাবে বলেই অনুমান করছেন গবেষকদের একাংশ।
২০১৪ সালে এর অস্তিত্ব আধুনিক পৃথিবীর সামনে প্রকাশ্যে আসতেই প্রত্নতাত্ত্বিকরা অনুসন্ধান করতে হ্রদের গভীরে নেমে অনেক নমুনা সংগ্রহ করেছেন। জলস্তরের তলদেশ থেকে পাওয়া যায় স্কটিশ নাইটদের স্মারকচিহ্ন। অনুমান করা হয়, তাঁরাই এই ব্যাসিলিকার প্রথম বিদেশি পর্যটক। পাশাপাশি গির্জায় বেশ কিছু সমাধি আছে বলেও জানিয়েছেন প্রত্নতত্ববিদরা। ইজনিক হ্রদ জুড়ে আন্তঃসলিলা প্রত্নক্ষেত্র (আন্ডারওয়াটার আর্কিয়োলজিক্যাল সাইট) গড়ে তোলার পরিকল্পনা নিয়েছে তুরস্ক।
সূত্র- আনন্দবাজার
