পেটের টানে, ঝুঁকিপূর্ণ পেশা বেছে নিতে হয়েছে হিঙ্গলগঞ্জ, গোসাবা, কুলতলি, পাথরপ্রতিমা এবং বাসন্তী ব্লকের গ্রামবাসীদের। রোজকার জীবন এবং জীবিকার জন্য জঙ্গলের উপর নির্ভরশীল তাঁদের জীবন, তাই এইসব অঞ্চল সংলগ্ন জঙ্গলে বাঘের উপস্থিতি তাঁদের কাছে খুব বড় সন্ত্রাসের কারণ। বেশ কিছু পরিবারে প্রতিটি প্রজন্মই তাদের পুরুষ সদস্যদের বাঘের আক্রমণে খুইয়েছে। কারওর আবার চোখের সামনেই স্বামীকে টেনে নিয়ে গিয়েছে বাঘে। ভেসে গিয়েছে সংসার। অধিকাংশ পরিবারেই মহিলাদের জীবন যন্ত্রণা এবং দারিদ্র্যে ভরা। পুনরায় বিয়ে করাকে এখনও সমাজ সুনজরে দেখে না বলে এই বিধবাদের জন্য পুনর্বিবাহ করাটাও খুব কঠিন। পেটের দায়ে তাই তাঁরা সব জেনেও মৃত স্বামীদের মতোই ঝুঁকি নেন রোজ। অভিযোগ, সরকারের থেকে ছিটেফোঁটা সাহায্য জোটেনি কারও।
এই ব্লকগুলি সুন্দরবন জাতীয় উদ্যানের (এবং ব্যাঘ্র সংরক্ষণ প্রকল্প) খুব কাছে অবস্থিত; জাতীয় উদ্যানের প্রায় ১,৭০০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জঙ্গলের মূল বা কোর এরিয়ার এবং প্রায় ৯০০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা অতিরিক্ত বা বাফার এরিয়ার অন্তর্ভুক্ত। একমাত্র অতিরিক্ত বা বাফার এরিয়াতেই জীবিকার প্রয়োজনে গ্রামবাসীদের প্রবেশ করার সীমিত অনুমতি আছে। সাধারণত গ্রামের পুরুষেরাই মাছ এবং কাঁকড়া ধরতে এবং মধু সংগ্রহ করতে জঙ্গলে পাড়ি দেন। এ ব্যাপারে এলাকাবাসীদের বক্তব্য- তাঁরা বাফার এবং কোর এরিয়ার সীমারেখা বুঝতে পারেন না, জীবিকার সন্ধানে এই সীমারেখা পার করতে হয়। এর পর বাঘের সামনে পড়লে ঘটে দুর্ঘটনা। বাঘের আক্রমণে স্বামী মারা গেলে সেইসব স্ত্রীদের বলা হয় ‘বাঘ বিধবা’। বেশির ভাগ গ্রাম যেখানে বাঘের আক্রমণে পুরুষরা মারা গেছেন সেখানে ‘বিধবা পাড়া’ খুঁজে পাওয়া যাবে। বাঘ-বিধবা’দের সকলেরই অভিযোগ, তাঁদের বিষয়ে রাজ্য সরকার উদাসীন। বরং সাহায্য চাইতে গেলে বন দফতর থেকে জুটেছে তিরস্কারই। নানা রকম নথির কথা বলে বিভ্রান্ত করা হয়েছে বারবার। সুন্দরবনে এই এক গল্প সর্বত্র শোনা যায়।
- জর্জ ফ্লয়েড হত্যায় বিশ্ব জুড়ে উঠেছে প্রতিবাদের ঝড়, আমেরিকায় ‘রেসিসম’-এর বিরুদ্ধে কলম ধরলেন অভিনেতা জর্জ ক্লুনি
- আমফানের এক-সপ্তাহের মধ্যে রাজ্যে কালবৈশাখী; মৃত ৩
পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বনদপ্তর, মৎস্য দপ্তর এবং সরকারের যৌথ ব্যক্তিগত দুর্ঘটনা বিমা প্রকল্প থেকে এই মহিলাদের মোট ক্ষতিপূরণ বাবদ ৪-৫ লক্ষ টাকা পাওয়ার কথা। কিন্তু এই ক্ষতিপূরণ শর্তসাপেক্ষ-
- স্বামীর মৃত্যু জঙ্গলের কোর এলাকায় হলে চলবে না
- মৃত্যুর সময় স্বামীর সঙ্গে বোট লাইসেন্স সার্টিফিকেট (বিএলসি) এবং বন দপ্তরের অনুমতিপত্র থাকতে হবে।
এছাড়া,
- ক্ষতিপূরণ দাবী করার জন্য স্ত্রীকে বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে নানান নথিপত্র জমা দিতে হবে।
এলাকাবাসীদের দাবি, রাজ্যে কেউ বিষ মদ খেয়ে মারা গেলেও সরকারি সাহায্য মেলে। অথচ কোনও মৎস্যজীবী বাঘের পেটে গেলে তাঁর পরিবারের দিকে ঘুরেও তাকায় না কেউ। হিঙ্গলগঞ্জ, গোসাবা, কুলতলি, পাথরপ্রতিমা এবং বাসন্তী ব্লকের গ্রামবাসীরা রোজকার জীবন এবং জীবিকার জন্য জঙ্গলের উপর নির্ভরশীল। তাঁদের জন্য এইসব অঞ্চল সংলগ্ন জঙ্গলে বাঘের উপস্থিতি খুব বড় ভয়ের কারণ। তাঁদের আক্ষেপ, সুন্দরবনের মানুষজন প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে জঙ্গলের উপরে নির্ভরশীল হলেও অরণ্যের অধিকার আইনের কোনও সুবিধাই তাঁরা পান না। ‘টাইগার উইডো ওয়েলফেয়ার সোসাইটি’র মতো কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা বাঘ বিধবাদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়েছে। কার্যত বাঘ বিধবাদের অনিশ্চয়তার মধ্যেই জীবন অতিবাহিত করতে হচ্ছে।
