সুপার সাইক্লোন আমফানের রোষে সুন্দরবনের বাস্তুতন্ত্রে পরিবর্তন ঘটেছে। মাটিতে নোনা জলের পরিমাণ বেশি হওয়ায় সংকটকালীন অবস্থার মুখোমুখি সবুজের দল। ঝড়ের তীব্র দাপটে ম্যানগ্রোভের উপরিঅংশ ঘষা লেগে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। ক্রমশ সুন্দরবনের চেনা সবুজ রং পরিবর্তন করে হলুদ হয়ে যাচ্ছে। উপযুক্ত কারণ দর্শাতে শুরু হয়েছে বিজ্ঞানীদের গবেষণা কার্য।
সুন্দরবনে প্রায় ৪২০০ বর্গ কিমি সংরক্ষিত জঙ্গল রয়েছে এবং তার বাইরে ৫৪০০ বর্গকিমি অঞ্চল রয়েছে। আমফানের প্রভাবে প্রায় ১৫০০ বর্গ কিমি বনাঞ্চল ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। শুকিয়ে যাচ্ছে সুন্দরবনের সমুদ্র, নদী ও খাঁড়ি উপকূলের ম্যানগ্রোভ বন। কেওড়া ও বাইন বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্থ। বাদ পড়েনি সুন্দরীও। এমনকি সুন্দরবনের মূল ভূখণ্ডের আম, কাঁঠাল গাছের পাতাও হলুদ হয়ে যাচ্ছে। এর আগে এমন দৃশ্য দেখেননি এলাকাবাসী। এমন পরিবর্তন দেখে পরিবেশবিদরা যথেষ্ট উদ্বিগ্ন। অতীতেও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছে এই ম্যানগ্রোভ অঞ্চল। এর আগে আয়লাতেও গাছের পাতা বিবর্ণ হয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে কিন্তু আমফানের প্রভাব তীব্র। প্রায় আড়াই লক্ষ গাছ ভেঙে গিয়েছে বা উপড়ে পড়েছে। কিন্তু যে গাছগুলো দাঁড়িয়ে আছে সেগুলিরও পাতা হলুদ হয়ে শুকিয়ে যাচ্ছে। এক ঝটকায় গাছগুলোকে দেখলে মনে হবে হয়তো আগুনে পুড়ে গিয়েছে। প্রকৃতির রুদ্ররোষে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এহেন পরিবর্তন যথেষ্ট হৃদয়বিদারক।
এ ব্যাপারে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটানির বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক কৃষ্ণেন্দু আচার্যের বক্তব্য অনুযায়ী- “সামুদ্রিক নোনা হাওয়ার কারণে আম, কাঁঠাল গাছের পাতা হলুদ হয়ে যেতে পারে। যদি ওই অঞ্চলের মাটিতে নুন ফুটে ওঠে সেটা হলে পাতা বিবর্ণ হওয়ার অন্যতম কারণ। কিন্তু ম্যানগ্রোভ নোনা জলের গাছ। এটা কেন হলুদ হচ্ছে তা স্পষ্ট নয়। প্রবল ঝড়ে ওইসব গাছের শিকড় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে- হয়তো সেই কারণেই এমন রং পরিবর্তন।ক্ষতিগ্রস্ত ম্যানগ্রোভের ওপর বিশদ পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজন রয়েছে”।
নামখানা, পাথরপ্রতিমা অঞ্চলের বাসিন্দাদের মতে, আমফানের বৃষ্টিতে লবণের পরিমাণ ছিল বেশি। অনেকেই বলেছেন বৃষ্টিতে ভেজার পর গা জ্বালা অনুভব করেছিলেন। এমনকি বৃষ্টির জলের স্বাদও ছিল নোনতা। অন্যান্য বৃষ্টির থেকে এটি যথেষ্ট আলাদা। আমফানের তীব্র ধ্বংসলীলার ফলে ওলট পালট হয়ে গেছে সুন্দরবনের সবুজ অংশ। জেলা প্রশাসনের দ্বারা নতুন চারা রোপণ করা হয়েছিল কিন্তু প্রকৃতির রুদ্ররোষে সবই নষ্ট হয়ে গিয়েছে। অবশ্য তীব্র ঝড়ের কারণে ম্যানগ্রোভের ওপরের অংশ শুকিয়ে হলুদ হয়ে গেলেও নিচের অংশ অক্ষত রয়েছে। নোনা জলের ঝাপটায় এমন ক্ষতি হয়েছে বলে আশঙ্কা করছেন এলাকাবাসীরা।
আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু ইন্ডিয়ান বোটানিক্যাল গার্ডেনের প্রাক্তন যুগ্ম অধিকর্তা হিমাদ্রি শেখর দেবনাথের বক্তব্য অনুযায়ী, “মাটিতে অতিরিক্ত লবণ হয়ে পড়লে ম্যানগ্রোভের পাতা হলুদ হয়ে যেতে পারে। ম্যানগ্রোভ মিষ্টি এবং লবণাক্ত জলের মিশ্রণে বাঁচে। যদি নোনা জল ও পিএইচ এর অনুপাত গুলিয়ে যায় সেক্ষেত্রে এমন ঘটনা দেখা যেতে পারে। তবে এ বিষয়ে বিশদ ভাবে পরিবেশ বিজ্ঞানীদের গবেষণা করা প্রয়োজন।” রাজ্যের বনমন্ত্রী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন, “সুন্দরবনের এমন ঘটনার কথা তিনি শুনেছেন। পুরো বিষয়টিকে দেখতে তিনি কিছুদিনের মধ্যেই সুন্দরবন সফর করবেন।”
